‘ধামাচাপা দেওয়া হয়’ ব্যাংকের অডিটের তথ্য

Post Image

বাংলাদেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের অডিট বিভাগের প্রতিবেদন ‘ধামাচাপা’ দেওয়া হয় বলে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) করা এই গবেষণায় বলা হয়েছে, “ব্যাংকের অডিট বিভাগ যে রিপোর্ট দেয় তা প্রকাশ পায় না। বোর্ড ও উচ্চ পদস্থ ব্যবস্থাপকদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এর ফলে অডিটে কোনও অনিয়মের তথ্য থাকলে তা সঠিকভাবে প্রকাশ পায় না।”

বৃহস্পতিবার মিরপুরে বিআইবিএমে ‘ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স অব ব্যাংকস’ শিরোনামের একটি কর্মশালায় এই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

বিআইবিএমের অধ্যাপক ও পরিচালক মো. মহিউদ্দিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি গবেষক দল ‘রিভিউ পেপার অন ইনটারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স অব ব্যাংকস ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। দেশের সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংক মিলিয়ে ৩৪টি ব্যাংকের উপর এই গবেষণা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “ব্যাংকের টপ ম্যানেজমেন্টের ইচ্ছার উপর অনেক কিছুই জড়িত। এজন্য ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স (আইসিসি) বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।”

সে কারণে ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তাই এই বিভাগে কাজ করতে চান না বলে গবেষকদের পর্যবেক্ষণ। তারা বলছেন, এই বিভাগে যে সব কর্মকর্তা কাজ করেন তাদের অন্য কাজও করতে হয়। অনেক সময় তাদের লাভের টার্গেট দেওয়া হয়।

দেশের ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র একটি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়।

এই গবেষকদের মতে, ১৮টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সন্তোষজনক, মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে ২৬টি ব্যাংকে, কোনোমতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে ১০টি ব্যাংকে এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খারাপ একটি ব্যাংকে।

 অডিট কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য যাতে ঠিকমতো প্রকাশ হয় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন তারা।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএমের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান। বিআইবিএম মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় ঢাকা ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী, এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসাইন বক্তব্য রাখেন।

ডেপুটি গভর্নর রাজী হাসান বলেন, “টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২০০৩ সালে কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেওয়া হয়। সেটি এখন সময়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা ‘প্রতিনিয়ত উন্নত করার’ পাশাপাশি অনলাইন মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং সাম্প্রতিক ফরমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে অনিয়মের জন্য সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাবকে দায়ী করেন ঢাকা ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ।

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যাংকের ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন তিনি।

এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “কমপ্লায়েন্স ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের অভাবে ব্যাংকিং খাতের এই দুরবস্থা। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে পরিচালনা বোর্ড, ম্যানেজমেন্ট এবং শাখা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে সৎ, যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন।”

ব্যাংকের পরিচালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ইয়াছিন আলী। ব্যাংকগুলোর ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগ যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা চান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক।

এই বিভাগে কাজ করার জন্য কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দেওয়ারও প্রস্তাব করেন তিনি।

ইয়াছিন আলীর সঙ্গে একমত পোষণ করে সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “আমিও এটা মনে করি যে, ব্যাংকের পরিচালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা খুবই প্রয়োজন।”

এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহমুদ হোসাইন বলেন, “সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালনা বোর্ড ঠিক হলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখানে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালনা বোর্ডের টোন অব দ্য টক বুঝতে হবে। অডিট কমিটি এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্টকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”

বছর শেষে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা বাড়ানোর চিন্তায় থাকে বা মুনাফার টার্গেট করা হয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।